লাম্পি স্কিন ডিজিজ (Lumpy Skin Disease)
গবাদি পশুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ হলো ভাইরাস জনিত সংক্রামক রোগ যা পক্সভিরিডি পরিবাররে (Family Poxviridae) অন্তর্ভূক্ত । অবশ্য এরোগের ভাইরাসকে নিথলিং (Neethling Virus) ভাইরাসও বলা হয় । গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্তের ফলে দীর্ঘকালস্থায়ী দূর্বলতা (Chronic debility),দুগ্ধ উৎপাদন হ্রাস (Reduce milk production) ,দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস (Poor growth) ,অনুর্বর (Infertility) ,গর্ভপাত (Abortion) এবং কোন কোন সময় মৃত্যু (Sometimes death) পর্যন্ত হয়ে থাকে ।
লাম্পি স্কিন ডিজিজ কিভাবে ছড়ায় (How is Lumpy Skin Disease spread) :–
প্রাথমিকভাবে রোগটি পোকাড় কামড়ে গবাদি পশুতে ছড়িয়ে পড়ে । বিশেষ করে মশা , ডাশ ,মাছি ,আঁটালির মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে এ রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে; এমনকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকার গবাদি পশুতেও । আক্রান্ত গবাদি পশুর সাথে সুস্থ গবাদি পশুর সরাসরি সংস্পর্শ ,মুখের লালা ,নাকের শ্লেস্মা , দুধ ও আক্রান্ত ষাড়ের সিমেনের মাধ্যমেও ছড়ায় । এছাড়াও গরুর রাখাল ,দুগ্ধ দোহনকারী , দুধ বিক্রেতা , চিকিৎস্যক ,পরিদর্শক ,পরামর্শক, আক্রান্ত খামারের খাদ্য ,যন্ত্রপাতি ,সূচ ইত্যাদির মাধ্যমে যে কোনভাবে এ রোগের ভাইরাস ছড়াতে পারে । এ ভাইরাস অতি তীব্র মাত্রায় (High concentration) থাকে আক্রান্ত গবাদি পশুর চামড়ার নীচে নডিউলে ও চামড়ার মামরিতে (Skin nodules and scabs) । এ ছাড়াও আক্রান্ত গবাদি পশুর রক্তে , মুখের লালা , নাক ও চোখ নিঃসৃত পানিতে (Occulo nasal discharges) ও সিমেনে (Semen) । লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস গবাদি পশু আক্রান্তের পরেও রক্তের মধ্যে ২১ দিন এবং সিমেনে টানা ৪২ দিন পযর্ন্ত সংক্রামক অবস্থায় বিদ্যমান থাকে (Lumpy skin disease can be found in blood for up to 21 days post infection and shedding in semen may continue for at least 42 post infection) ।
রোগের ইতিহাস (History of Lumpy Skin Disease) :–
লাম্পি স্কিন ডিজিজ সর্বপ্রথম ১৯২৯ সালে জাম্বিয়ায় গবাদি পশুতে দেখা দেয় । পরে জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, উগান্ডা সহ আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেই রোগটি ছড়িয়ে পরে । বাংলাদেশে ২০১৯ সালের মার্চ -এপ্রিল প্রথম উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জেলায় দেখা দিলেও পরবর্তীতে মে মাসের প্রথম দিকে নরসিংদী সহ প্রায় সকল জেলায় লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয় । এর আগে রোগটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও চায়নার গবাদি পশুতে সংক্রামিত হয়েছিল । তাই অনেকেই ধারণা করে থাকেন লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস পার্শ্ববর্তী দেশ সরাসরি ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা গবাদি পশু অথবা কোন ধরণের বাহকের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে । তবে অনেকে ধারণা করেন যে , দেশের বাহির থেকে কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্যে সিমেন নিয়ে আসা হয় ,সে ক্ষেত্রেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সিমেনের মাধ্যমে লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস ছড়াতে পারে ।
রোগের লক্ষণ (Symtomes of disease) :–
সংক্রমণের সাথে সাথেই এ রোগের তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না । গবাদি পশুর দেহে সংক্রমণের কয়েকদিন পর লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর লক্ষণ সমূহ দেখা দেয় । কারণ লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাসের সুপ্তিকাল ৪-১৪ দিন যা সংক্রমণের পর লক্ষণ সমূহ দৃশ্যমান হয়। এটি একটি ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ । এ রোগের বৈশিষ্ট হলো জ্বর (Fever) , বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান লসিকাগ্রন্থি সমূহ বড় হওয়া (Enlargeed superficial lymphnodes) ,চামড়া ও মিউকাস মেমব্রেনে গুচ্ছাকারে অনেকগুলো ছোট ছোট লসিকা গ্রন্থি (Multiple nodules on the skin membranes) যা দেখতে ২-৫ সে.মি. ডায়ামিটার । এ সব গ্রন্থি শ্বাসতন্ত্র ও গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনালের মিউকাস মেমব্রেনেও হয়ে থাকে । আক্রান্ত গবাদি পশুর পায়ে শ্বোথ (Oedematous swelling) হলে প্রাণি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটবে । এ ভাইরাসে আক্রান্ত গবাদি পশুর জন্য ব্যাপক আর্থিক হুমকি স্বরূপ । আক্রান্ত গবাদি পশুর চামড়ার কারর্কারীতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দ্বাড়ায় ।
গবাদি পশুতে এ ভাইরাস সংক্রমণের পর কমপক্ষে এক সপ্তাহ পরে জ্বর দেখা দেয় । প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত গবাদি পশুতে জ্বর ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে ও এক সপ্তাহ পর্যন্ত তা বিড়াজমান থাকে (Fever persist for one week) । ভাইরাস সংক্রমণের ৭-১৯ দিন পর আক্রান্ত গবাদি পশুর সকল বাহ্যিক লসিকা গ্রন্থি সমূহ আকারে বড় হয় যা দেখতে গোটা গোটা (Nodules) বা গুটির মতো হয়ে থাকে। চোখ ও নাসিকা ছিদ্র দিয়ে আঠালো রস (Mucopurulent discharges from eyes and nasal orifice) বের হতে থাকে । গোটা সমূহ (Nodules) চামড়ার বিভিন্ন স্তরে সম্প্রসারিত হয়ে মাংসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং দেহের সর্বত্রই লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পায় । বিশেষ করে মাথা , ঘাড় ,দুগ্ধ গ্রন্থি ,স্ক্রোটাম (Scrotum) যোনিপথ (Vulva), পেরিনিয়াম (Perinium) ইত্যাদি সহ শরীরের যে কোন অংশে গোটা সমূহ একত্রিত (Coalesce) হয়ে দৃশ্যমান হয়ে থাকে ।
কিউটেনিয়াস লক্ষণ সমূহ দ্রুত মিশে যেতে পারে আবার শক্ত পিন্ডাকৃতির আকার ধারণ করে দীর্ঘ মেয়াদে থেকেও যেতে পারে । গোটাসমূহ ফেটে (Ruptured nodules) গিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে আবার রস ঝরতে পারে ।
চিকিৎসা (Treatement) ;–
লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস জণিত হওয়ার কারণে সুনির্দিস্ট কোন চিকিৎসা নেই । রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। জ্বর না থাকলে গবাদি পশুকে পর্যাপ্তমাত্রায় পুষ্টিকর খাবার ও ইলেক্ট্রোলাইট সরবরাহ দিতে হবে । প্রাথমিক অবস্থায় গবাদি পশুর শরীরে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি তাপমাত্রা থাকে ; তাই প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে এন্টিপাইরেটিক –এনালজেসিক ব্যবহার করে দেহের তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। লসিকাগ্রন্থি সমূহ ফেটে গিয়ে রক্ত রস বের হলে কিংবা দ্বিতীয় ধাপে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দেখা দিলে উপযুক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে । চামড়া ফেটে গেলে নিযমিত টিংচার আয়োডিন দ্বারা ধৌত করাতে হবে । ক্ষত স্থানে যাতে মাছি বসতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নজর দারি রাখতে হবে । অনেকেই আক্রান্ত গবাদি পশুকে খাবার সোডা ও নিম পাতা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ।
প্রতিরোধে করণীয় (How to prevent Lumpy Skin Disease) :–
রোগটি গবাদি পশুতে কিভাবে ছড়ায় তার পুরো ইতিহাস জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । যেহতু এ রোগের ভাইরাস মশা ,মাছি , ডাশ ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায় তাই গবাদি পশুকে মশারি দ্বারা ঢেকে রাকতে হবে । গবাদি পশুর দেহে আটালি থাকলে তা নির্মূল করতে হবে । একই সূচ একাধিক গবাদি পশুতে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে ।
আক্রান্ত গবাদি পশুকে অবশ্যই পৃথক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বাজার থেকে নতুন কোন গবাদি পশু ক্রয় করলে তা কোয়ারেন্টাইন কক্ষে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
মশা,মাছি, ডাশ, আটালির প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে । গবাদি পশুর খামরের চারপাশের পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। খামারের ভিতরে ও বাহিরে নিয়মিত ফিনাইল স্প্রে করতে হবে । এতে মাছির বংশ বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হবে । এছাড়াও খামারের চারপাশে ঝোপ-ঝাড় থাকলে তা পরিস্কার করতে হবে ।
খামারে অযাচিতভাবে পরিদর্শনকারীর ভীর এড়িয়ে চলতে হবে । এক কথায় , খামার পরিচালনার ক্ষেত্রে জীব নিরাপত্তার নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস জনিত রোগ হওয়ায় এর কোন সুচিকিৎসা নেই । তাই এ রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশে এ রোগের কোন ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়নি । উল্লেখ্য যে, গবাদি পশুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধে গোট পক্স ভ্যাকসিন (Goat pox Vaccine) ও ভেড়ার পক্স ভ্যাকসিন (Sheep Pox Vaccine) প্রয়োগে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় । বাংলাদেশে গোট পক্স ভ্যাকসিনের কোন ঘাটতি নেই । তাই এ রোগ প্রতিরোধে গোট পক্স ভ্যাকসিন (Goat Pox Vaccine) ব্যবহার করতে হবে।
আর্থনৈতি গুরুত্ব (Economic importance): —
লাম্পি স্কিন ডিজিজ বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ বিভাগ বিশেষ করে ডেইরি সেক্টরের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে। ডেইরি সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একটি বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে । আক্রান্ত গবাদি পশু বিশেষ করে উৎপাদনশীল গাভীর উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে ,বাড়ন্ত পশুর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়েছে, আক্রান্ত গাভী ও বকনা সমূহ ইনফার্টিলিটি রোগে ভুগবে,মাংসের উৎপাদন হ্রাস পাবে ,রপ্তানীকারক দ্রব্য বিশেষ করে চামড়ার গুণগত মান নস্ট হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক বাজারে চলবে না । এমনকি দেশীয় বাজারেও বাজার মূল্য বহুলাংশে কমে যাবে। ফলে বৈদেশিক ও দেশিও মুদ্রার উপর বিরাট প্রভাব পরবে । এতে করে দেশিয় দুধের ঘাটতি দেখা দিলে তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে । ইনফার্টিলিটি রোগে ভুগলে গবাদি পশুর বংশ বিস্তার হ্রাস পাবে । গর্ভবতী গবাদি পশুর গর্ভপাত ঘটে এবং কোন কোন সময় গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটার কারণে দেশের বিরাট আর্থিক ক্ষতি সাধন হয় । দেশের চামড়া শিল্পের ধ্বস নামবে । মানুষের কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে। এ রোগ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে না পারলে দেশের মানুষ গবাদি পশু পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে । তাই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে যে কোন উপায়ে দেশ থেকে লাম্পি স্কিন ডিজিজ এর মতো ভাইরাসকে মুলোৎপাটন করতেই হবে।