মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হওয়ার কারণ

মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হওয়ার কারণ /Reasons for thin shelled eggs in Poultry

মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হওয়া মুরগির খামারিদের একটি অন্যতম সমস্যা। নানা কারণেই ডিমপাড়া মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হতে পারে । ডিমের খাঁসা পাতলা হলে ডিম সহজেই ভেঙ্গে যায় ; যার ফলে খামারিরা পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম সংগ্রহ করতে পারে না কিংবা সংগ্রহ করলেও ঐ ডিম গননার আওতায় আনতে পারে না কিংবা তা’ বাজারজাত করতে পারে না । পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম মুরগির নাগালে গেলে তা’ মুরগির ডিম ভক্ষণের অভ্যাস গড়ে উঠে। ডিম ভক্ষণের অভ্যাস অনেক সময় খামারের সব মুরগির মধ্যে ছড়িয়ে পরতে পারে । মুরগির ডিম ভক্ষণের অভ্যাস একবার গড়ে উঠলে তা’ দূর করা বেশ মুশকিল হয়ে ওঠে। ডিমের খোঁসা পাতলা হলে খামারিরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং খোঁসা পাতলাযুক্ত ডিম হ্যাচিং এর জন্য উপযুক্ত নয় । ফলে হ্যাচারি মালিকগণ ক্ষতিগ্রস্থ হন । তাই পোলট্রি খামারিদেরকে ডিমের খোঁসার গঠন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা একান্ত জরুরি। নিম্নে অতি সংক্ষেপে ডিমের খোঁসা পাতলা হওয়ার কতিপয় কারণ চিহ্নিত করে তা’ আলোচনা করা হলো –

১। জীনগত কারণ (Genetics cause) :– অতি উৎপদনশীল কতিপয় ব্রিড রয়েছে যাদের পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম উৎপাদনের প্রতি ঝোক বেশি। বিষয়টি জীনগত হলে তা’ কোনভাবেই সংশোধন করা সম্ভব নয়। তবে এ ধরণের সমস্যা খুব বেশি প্রোকট আকার ধারণ করে না। খামারে অনেক মুরগির মধ্যে কিছু সংখ্যক মুরগিতে কালে- ভদ্রে এ জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে।

২। মুরগির ডিম্বাশয়ে ডিমের অবস্থান বা পজিশন (Position of egg in a chicken Ovary):–

ডিম্বাশয়ের থোকায় শক্তভাবে এঁটে থাকা শেষ (Last egg in a clutch has a poor shell quality)  ডিমের খোঁসা দূর্বল ও পাতলা হয়। এটি একাট স্বাভাবিক প্রক্রিয়া । বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়স্ক মুরগিতে (Aged laying hen) এ ধরণের সমস্যা পরলিক্ষিত হয়।

৩। দীর্ঘ্য সময় ধরে ডিম উৎপাদন (Length of lay) :–

মুরগির স্বাভাবিক ডিম পাড়ার সময় হলো ২০ সপ্তাহ থেকে ৭২ সপ্তাহ পযর্ন্ত। তারপরেই শুরু হয় ছাটাই পর্ব (Culling period)। কিন্তু মুরগির ডিমের উৎপাদন ভালো থাকলে কিংবা ডিমের বাজার মূল্য ভালো থাকলে খামারিরা মুরগি ছাটাই (Culling) না করে অধিক মুনাফার আশায় আর দীর্ঘ্য সময় ধরে পালন করে । আবার বাজারে বাচ্চার (Day old chicks)  ঘাটতি থাকলেও খামারিরা উৎপাদনের মুরগি ডিম উৎপাদনের সীমা অতিক্রম করলেও তা’ ছাটাই করতে আগ্রহী নন। এমতঃবস্থায় অধিক বয়সের মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা বা নরম হয়।

৪। তাপমাত্রা (Temperature) : —

মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা (In hot climate) , মুরগির ধকল/পীড়নের কারণ। এ ধরণের ধকলে মুরগি আক্রান্ত হলে অধিক হারে মুখ খুলে বা হা করে শ্বাস গ্রহণের কারণে(Panting)  মুরগির দেহে কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2) হ্রাস পাওয়ায় পর্যাপ্তমাত্রায় ক্যালসিয়াম কার্বনেট উৎপাদন ব্যহত হয়। ফলে অধিক গরমের দিনে মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হয়।

৫। মুরগির রোগ (Disease hen birds) :–

মুরগির কতিপয় রোগ বিশেষ করে ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস, রাণীক্ষেত রোগ,এগ ড্রপ সিন্ড্রোম এ জাতীয় রোগে আক্রান্ত হলে পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম পাড়ে। রাণীক্ষেত রোগের টাইটার লেভেল কমে গেলেও ডিমের খোঁসা পাতলা ও ডিমের রঙ্গের তারতম্য হতে পারে। তাই মুরগির নিয়মানুযায়ী রাণীক্ষেত রোগের টাইটার লেভেল পরী্ক্ষা করা দরকার এবং উপযুক্ত সময়ে মুরগিকে রাণীক্ষেত রোগের ভ্যাকসিন প্রদান করা দরকার।

৬। বাতাসের আর্দ্রতা (Humidity) : —

বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হয়।

৭। খাদ্যে পুষ্টির অভাব (Nutritional deficiency in poultry feed) : —

পোলট্রি খাদ্যে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন –ডি এর ঘাটতি থাকলে ডিমের খোঁসা পাতলা হবে।

৮। পোলট্রি খাদ্যে ডলোমাইট ক্যালসিয়াম এর ব্যবহার (Uses of Dolomite calcium in poultry feed) : —

পোলট্রি খাদ্যে সাধারণত ডাই-ক্যালসিয়াম ফসফেট (DCP) ,ঝিনুক, শামুক ও লাইম স্টোন ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে। এগুলো পোলট্রি খাদ্যে সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করলে ডিমের খোঁসা শক্ত হয়। কিন্তু ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে যদি ডলোমাইট ক্যালসিয়াম ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হয় এবং মুরগির বিষ্ঠা নরম হয় (Feeding of Dolomite calcium causes thin shell & wet droppings) । ডলোমাইট ক্যালসিয়াম হলো –  Ca Mg(C3)2 । যা ক্রিস্টাল ফর্মে থাকে।

৯। ট্রেস মিনারেল (Trace minerals) : —  

পোলট্রি খাদ্যে ট্রেস মিনারেল বিশেষ করে ম্যাঙ্গানিজ,সোডিয়াম,পটাশিয়াম ও ক্লোরাইড ব্যবহার করা হয়। খাদ্যে এসব উপাদনের ঘাটতি থাকলে মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হয়।

১০। মানসম্মত খাবার পানি (Quality of drinking water) : —

মুরগিকে সরবরাহকৃত খাবার পানি সর্বদাই মানসম্মত হওয়া উচিৎ। পানিতে যদি অতি উচ্চ মাত্রায় ক্লোরাইড লবণ থাকে সেক্ষেত্রে মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হয়।

১১। পোলট্রি খাদ্যে জিঙ্ক-মিথিওনিনের অভাব (Deficiency of Zinc-Methionine in poultry feed) : —

পোলট্রি খাদ্যে মিথিওনিন হলো অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড। মুরগির দেহে মিথিওনিন সংশ্লেসন হয় না। আবার খাদ্যে জিঙ্কের ঘাটতি থাকলেও মিথিওনিন এককভাবে কাজ করে না। অতএব, পোলট্রি খাদ্যে যদি জিঙ্ক-মিথিওনিন এর ঘাটতি থাকে সেক্ষেত্রে মুরগির ডিমের খোঁসা পাতলা হয়।

পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম কতিপয় কারণে ভেঙ্গে যায়। তা’ নিম্নে বর্ণনা করা হলো –

ক) ডিমপাড়া মুরগিকে বিরক্ত করা (Disturbance of laying hen) : —

ডিমপাড়া মুরগিকে ডিম পাড়াকালীন সময়ে বিরক্ত করলে ঠিকভাবে ডিমের খোঁসা গঠন হবে না। আবার যদি মুরগি ডিমপাড়ার পূর্বে কোন কারণে ভয় পায় সেক্ষেত্রেও ডিমের খোঁসা তৈরিতে ব্যঘাত সৃষ্টি হয় । বিশেষ করে রাতের বেলায় খাবারের অন্বেষণে পোলট্রি খামারে ইদুঁরের উপদ্রব বেড়ে যায় । এতে মুরগি ভয় পেলে ডিমের খোঁসা গঠনে বাধাঁগ্রস্থ হয় এবং মুরগির দেহে পুষ্টি সঠিকভাবে কাজে লাগে না বরং মুরগি ধকলে আক্রান্ত হয়। এমতঃবস্থায় ,ডিমপাড়া মুরগি এজাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হলে ডিমের খোঁসা সঠিকভাবে গঠিত না হলে মুরগি পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম পাড়ে এবং ডিম অতি সহজে ফেটে (Cracked egg) যায়।

খ) মুরগি দাড়িয়ে ডিম পাড়লে (Hen laying of egg in standing  position) : —

খাঁচা পদ্ধতিতে অনেক খামারি এক খোঁপে হিসেবের চেয়ে অনেক সময় বেশি মুরগি ছেড়ে দেয় । এমতঃবস্থায় মুরগি ঠিক পজিশনে আরামদায়ক পরিবেশে ডিম পাড়তে পারে না। মুরগির অতিরিক্ত গাদাগাদির কারণে কোন কোন মুরগি দাড়িয়ে ডিম পাড়ে। এভাবে মুরগি দাড়িয়ে ডিম পাড়লে ডিম ফেটে (Cracked) যায়।

গ) ত্রুটিপূর্ণ  খাঁচার গঠন (Structural default  in cages) : —

ডিমপাড়া মুরগির খাঁচার গঠন সুবিণ্যাস না হলে মুরগি ডিম পাড়ার পর গড়িয়ে আসার সময় তা’ অনেক সময় ফেটে যেতে পারে।

ঘ) ত্রুটিপূর্ণভাবে ডিম সংগ্রহ (Mismenagemental  Egg collection) :–

সময় মতো ডিম সংগ্রহ করা একটি ভালো ব্যবস্থাপনার অন্যতম দিক। ডিম সংগ্রহ করতে দেরি হলে মুরগি নিজেই নিজের কিংবা অন্যের ডিম ভেঙ্গে ফেলে। আবার খামারে কর্তব্যরত কর্মচারির অসাবধানতার কারণে ডিম সংগ্রহ করার সময় ডিম ভেঙ্গে যেতে পারে।

ডিমের খোঁসা যাতে পাতলা না হয় সে বিষয়ে খামারিকে যথেষ্ঠ যত্নশীল হতে হবে এবং ডিম সংগ্রহের ব্যপারে নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাতে খামারি আরো বেশি ডিম বাজারজাত করতে পারবে। বেশি পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম বা ফেটে যাওয়া ডিমের সংখ্যা বেশি হলে খামারি বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।