পোলট্রি খামারে ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব ও এদের দমনে করণীয়–

পোলট্রি খামারে ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব ও এদের দমনে করণীয়–
ইঁদুর এমন এক প্রজাতির বন্যপ্রাণী যা মানুষের তেমন কোন উপকারে আসে না। সীমিত আকারে গবেষণার কাজে ব্যবহার হলেও এরা মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে। পোলট্রি খামারে ইঁদুর ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর অবাধ বিচরণ নেই এমন খামার খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ। আন্টার্টিকা মহাদেশ ব্যতীত বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সব দেশেই ইঁদুরের অবস্থান অতি সুসংহত। পৃথিবীতে এদের অবস্থান মানুষের তুলনায় ৪ গুণ বেশি।এরা গাছে,জংগলে,পাহারে,পর্বতে,মাটির গর্তে বসতি স্থাপন করে। তবে স্থলে বসবাস করলেও পানিতে সাঁতার কাঁটার মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্বাধীনভাবে যাতায়াত করে। যেখানে যেখানে খাবারের প্রাচুর্যতা আছে সেখানেই তারা দলবল সহ বসতি স্থাপন করে। পোলট্রি খামারে ইঁদুর শুধুমাত্র পোলট্রি খাদ্য খেয়ে খাদ্যই নষ্ট করে তা নয় ;এরা অনেক ধরনের সংক্রামক রোগ জীবাণু বহন করে যা মানুষ সহ খামারে পালিত মুরগির দেহে অতি সহজেই ছড়াতে পারে ;যা খামারে পালিত মুরগির জন্য প্রাণঘাতী ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিকর।
ইঁদুর যে খাদ্য খায় তার চেয়ে অনেক বেশি অপচয় করে;যা অপরিমেয়। আমাদের দেশের পোলট্রি খামারিরা খামারে ইঁদুরের উপদ্রবজনিত ক্ষতিকর প্রভাব সমন্ধে একটু-আধটু ইতি-উতি করলেও ব্যাপক সচেতনতার অভাবে পুরো ব্যাপারটাই এড়িয়ে চলে;যা কোন ভাবেই একজন আদর্শ খামারির জন্য কাম্য হতে পারে না।
অনেক প্রজাতির ইঁদুর আছে। যাদেরকে আমরা সাধারণত ধেড়ে ইঁদুর (rat) ও নেংটি ইঁদুর (mice) হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। সম্মিলিত ভাবে এদেরকে সংক্ষিপ্তভাবে rodent নামে আখ্যায়িত করি।আকৃতিগতভাবে ধেড়ে ইঁদুর (rat) আকারে তুলনামূলকভাবে বড় এবং নেংটি ইঁদুর (mice) আকারে ছোট।
পূর্ণ বয়স্ক একটি ধেড়ে ইঁদুরের দৈহিক ওজন প্রায় ০.২ – ০.৩ কেজি। তবে ইউরোপের কোনো কোন দেশে বা অঞ্চলে ২.৫ কেজি পর্যন্ত ওজনের ইঁদুরের সন্ধান পাওয়া গেছে ;যাকে Gient rat বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ইঁদুর জন্মের মাত্র ৩ মাস বয়সেই প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। গর্ভকালিন সময় মাত্র ২১ – ২৩ দিন ;যা বছরে প্রায় ৬ – ১৪ বার বাচ্চা প্রসব করে এবং প্রতি গর্ভে ৭ – ৮ টি করে বাচ্চা প্রসব করে। ইঁদুর বাচ্চা প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পূণরায় heat এ আসে। গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র একজোড়া ইঁদুর (rat/mice) থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৫০০০ টি ইঁদুর (rat/mice) এর বংশ বিস্তার ঘটে।
অপরদিকে,পূর্ণ বয়স্ক একটি নেংটি ইঁদুর (mice) এর দৈহিক ওজন ২০ – ৩০ গ্রাম পর্যন্ত হয়।নেংটি ইঁদুর (mice) জন্মের মাত্র ৬ সপ্তাহ বয়সেই প্রজনন সক্ষমতা অর্জন করে এবং গর্ভকালিন সময় মাত্র ১৯ – ৩১ দিন ;যা বছরে প্রায় ৬ – ১০ বার বাচ্চা প্রসব করে।
ধেড়ে ইঁদুরের(rat) জীবনকাল ৩৬ – ৪০ মাস পর্যন্ত। ধেড়ে ইঁদুরের ন্যায় স্ত্রী নেংটি ইঁদুর প্রতি গর্ভে এক সাথে ৭ – ৮ টি বাচ্চা প্রসব করে এবং বাচ্চা প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পূণরায় heat এ আসে। নেংটি ইঁদুরের জীবনকাল ২১ – ৪০ মাস পর্যন্ত।
পোলট্রি খামারে Rat/Mice এর ক্ষতিকর প্রভাব :-
পোলট্রি খামারে Rat/Mice নিম্নলিখিতভাবে ক্ষতিসাধন করে —-
ক) খামারের অবকাঠামো ধ্বংস করার মাধ্যমে,
খ) সরবরাহকৃত খাদ্য খেয়ে অপচয় ঘটানোর মাধ্যমে,
গ)বিষ্ঠার (Fecal materials) মাধ্যমে পোলট্রি খাদ্যকে কলুষিতকরণ।
পোলট্রি খামারের অবকাঠামো ধ্বংস করার মাধ্যমে:-

ইঁদুর সাধারণত দল বেধে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।এদের ২০০ টি ইঁদুর নিয়েও এক একটি দল বা জোট হতে পারে। সাধারণত বয়স্ক পুরুষ ইঁদুর দলে নেতৃত্ব দেয়।আক্রমণের সময় এরা সম্মিলিত ভাবে অংশগ্রহণ করে। যেখানে যেখানে খাবারের প্রাচুর্য বা পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ থাকে ঠিক সেখানেই ইঁদুর বসতি স্থাপন করে। সাধারণত পোলট্রি খামারে খাদ্যের কোন অভাব বা ঘাটতি থাকে না। দেশের ছোট-বড় -মাঝারি সকল প্রকার পোলট্রি খামার ইঁদুরের বংশ বিস্তারের জন্য উপযুক্ত স্থান। পোলট্রি খামারের আশেপাশেই ইঁদুর গর্ত করে খামারের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো,ডিমের ট্রে,খাঁচা,খাদ্যের বস্তা,বৈদ্যুতিক তার,পর্দা ইত্যাদি নষ্ট করে। উৎপাদিত ডিমের প্রায় ০৫ – ১০ ডিম ভেংগে ফেলে। ছোট বাচ্চাকে আক্রমণের পাশাপাশি মেরেও ফেলে। খামারে খামারে ইঁদুরের উপদ্রব পোলট্রি খামারিদের জন্য অবশ্যই দুঃচিন্তার কারণ।
খাদ্য খেয়ে খামারের অপচয় করার মাধ্যমে:-
ইঁদুর বহু কিছুই খায় বা নষ্ট করে। বাদামি বর্ণের ধেড়ে ইঁদুর (Rattus Norvegicus) জন্মগত ভাবে দানাদার বা বীজভূক্ত হলেও ফলমূল,শাকসবজি ও লতাপাতাও খায়।এক একটি ধেড়ে ইঁদুর প্রতি দিন প্রায় ৩০ গ্রাম,নেংটি ইঁদুর ২ – ৩ গ্রাম পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ করে। প্রতি দিন প্রতিটি ইঁদুর (rat/mice)খাদ্য গ্রহণ ও নষ্ট করে প্রায় ১০০ গ্রাম। এরা দৈহিক ওজনের তুলনায় ২০% এর বেশি খাদ্য গ্রহণে সক্ষম ।প্রতিটি ধেড়ে ইঁদুর প্রতি দিন প্রায় ৩০ মিলি পানি গ্রহণ করে। নেংটি ইঁদুর প্রতি দিন প্রায় ৪ -৭ মিলি পানি গ্রহণ করে। পোলট্রি খামারে রাতের অন্ধকারে ঠিক কত সংখ্যক ইঁদুরের চলাফেরা আছে তার সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে দিনের বেলায় পোলট্রি খামারে যদি শুধুমাত্র একটি ইদুরও চোখে পড়ে তবে ধরে নিতে হবে সেখানে রাতের অন্ধকারে প্রায় ২০০ – ১৫০০ টি ইঁদুর দলবদ্ধভাবে অবাধে চলাফেরা করে।
পোলট্রি খামারে রোগের বাহক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে:–

প্রকৃত সত্য কথা হলো যে , আমাদের দেশের অধিকাংশ পোলট্রি খামারের খামার ব্যাবস্থাপনা এমনিতেই দুর্বল। জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো ঝুঁকিপূর্ণ। এটি হতে পারে পোলট্রি খামারিদের অবজ্ঞা,হতে পারে সচেতনতার অভাব,হতে পারে হেঁয়ালিপনা মনোভাব। তার জন্যই দেশের অধিকাংশ পোলট্রি খামারে হর-হামেশাই রোগের প্রাদুর্ভাব থেকেই যায়। পোলট্রি খামারিরা প্রায়শই অভিযোগ করেন যে,ডাক্তার সাহেবগণ যথাযথভাবে রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হন না। ভ্যাকসিন কিংবা মেডিসিন সঠিকভাবে কাজ করে না। জীবাণু নাশক ব্যবহার করার পরেও খামারের জীবাণু মরে না।আরো অনেক ধরনের অভিযোগ রয়েছে পোলট্রি খামারিদের মনে। মূলতঃ খামারিদের এসব অভিযোগ পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব না হলেও তাদের মধ্যে অসচেতনতা খামারে রোগের বিস্তার ঘটাতে বহুলাংশে দায়ী।
পোলট্রি খামারে ইঁদুরের উপদ্রব খামারে রোগ বিস্তারের একটি স্থায়ী মাধ্যম। ইঁদুর (Rat/Mice) মুরগিতে সালমোনেলার জীবাণু বিশেষ করে পুলোরাম রোগ (Salmonella Pullorum),ফাউল টাইফয়েড (Salmonella gallinarum) ,ফাউল প্যারাটাইফয়েড (Salmonella typhimeurium) এবং সালমোনেলা জনিত আমাশয় (Salmonella enteritidis),ফাউল কলেরা (Pasteurella multocida),রাণীক্ষত রোগ (ND),এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (AIV) ও এভিয়ান এরিজোনোসিস রোগ ছড়ানোর তথ্যও রয়েছে। বাদামি বর্ণের বন্য ধেড়ে ইঁদুর (Rattus Norvegicus) সালমোনেলার জীবাণু বহনে প্রকৃতিগত ভাবে সর্বদাই সক্রিয় এবং খামারের মুরগির জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত।
বিষ্ঠার মাধ্যমে (Fecal materials) পোলট্রি খাদ্যকে কলুষিতকরণ:-

দিনের আলো শেষে অন্ধকার নেমে আসার সাথেই ইঁদুর ফিরে আসে আপন স্বর্গরাজ্যে। খাবারের নেশায় মত্ত হয়ে এরা দ্বিগবিদ্বিগ স্বাধীনভাবে পোলট্রি খামারের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছোটাছুটি করতে থাকে। কখনো কখনো লাফ দিতে গিয়ে হঠাত্ মুরগির গাঁয়ে পরে গেলে মুরগি ভয় পায় এবং আতংকে মুরগির মধ্যে শোরগোল বেঁধে যায়। খামারে ইঁদুরের উপদ্রবজনিতকারণে মুরগি বেশি ভয় পেলে স্বাভাবিক উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। রাতের অন্ধকারে খাদ্যের পাত্রের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এরা স্বাধীনভাবে ছোটাছুটি করতে থাকে;এমতাবস্থায় এরা মল-মূত্র ত্যাগের মাধ্যমে পোলট্রি খাদ্যকে কলুষিত করে। প্রতিটি (rat/mice) দিনে প্রায় ৪০ বার মল-মূত্র ত্যাগ করে। ইঁদুরের বিষ্ঠায় সালমোনেলার জীবাণু বিশেষ করে Salmonella enteritidis ১৪৮ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকে ;যা পরবর্তীতে পোলট্রি খামারে রোগের বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে। এক কথায় বলা যায় যে, Rat/Mice সালমোনেলা পুলোরাম জীবাণু বহনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এবং পোলট্রি খাদ্য দূষণে এদের বিষ্ঠা রেডিমেড বস্তু হিসেবে কাজ করে।
পোলট্রি খামারে Rat/Mice দমনের উপায়:–
Rat/Mice শুধুমাত্র পোলট্রি শিল্পেরই ক্ষতিসাধন করে না। বিভিন্ন সেক্টরে এদের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। তাই ইঁদুরকে জাতীয় ভাবে দমন করা দরকার। দেশের উদীয়মান পোলট্রি শিল্পের বিকাশকে ধরে রাখতে হলে এদের পোলট্রি খামারিদেরকে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ক) পরিবেশগতভাবে নিয়ন্ত্রণ :–

এ পদ্ধতিতে পোলট্রি খামারে ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে হলে পোলট্রি খামার ও তার চারপাশে অবশ্যই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। খামারের অভ্যন্তরে কোনমতে খাদ্য যত্রতত্র ফেলে রাখা যাবে না। পোলট্রি খামার ও খাদ্যের গোডাউন Rat proof হতে হবে। পোলট্রি শেড এমন ভাবে নির্মিত হওয়া দরকার যাতে ইঁদুর কোনমতে গর্ত করতে না পারে এবং দরজা দিয়ে ইঁদুর শেডে প্রবেশ এড়ানোর লক্ষ্যে শেডে Self closing door তৈরি করা উচিত। পোলট্রি খামারিদেরকে খামারে ইঁদুরের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে কন্ট্রোল শেড তৈরির বিষয়ে ভাবতেই হবে।
ফাঁদ পাতানোর মাধ্যমে (Trapping method) : —

খ) ইঁদুর ধরার জন্য আজকাল বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তৈরিকৃত নানা ধরনের ফাঁদ পাওয়া যায়। ইঁদুরের উপদ্রব এলাকায় এ ফাঁদ পাতা যেতে পারে।
গ) পোষা বিড়াল পালনের মাধ্যমে-
ঘ) খামারে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ :-
পোলট্রি খামারে ইঁদুরের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা ইঁদুর নিধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। উল্লিখিত পদ্ধতিতে পোলট্রি খামারে ইঁদুর দমনে খামারে নিয়মিত Rodenticides ব্যবহার করতে হবে। বাজারে দু’ধরনের Rodenticides পাওয়া যায়।
১। একক মাত্রা (Single dose) :–
একক মাত্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয় Zinc phosphide যা ভক্ষণের ফলে ইঁদুর মারা যায়। এটি বৎসরে দু’বার ব্যবহার করা যায়।
২। বহুমাত্রিক (Multi dose) : –
বহুমাত্রিক হিসেবে Bromodiolone ব্যবহৃত হয়। এটি ইঁদুরের সরাসরি ইঁদুরের গর্তে প্রয়োগ করে গর্তের মুখ বন্ধ করলে গর্তের ভিতর বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস তৈরি হলে গর্তের ভিতরে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটে অথবা ইঁদুর এলাকা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। তবে এ জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এ জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীর জন্যও বিপজ্জনক।