মুরগির ঠোকরাঠুকরি সহ অন্যান্য বদ অভ্যাস জনিত সমস্যা ও তা প্রতিকারের উপায়

মুরগির ঠোকরাঠুকরি সহ অন্যান্য  বদ অভ্যাস জনিত সমস্যা ও তা প্রতিকারের উপায়

খামারে পালিত মোরগ-মুরগির মধ্যে অনাকাংখিত  ও অস্বাভাবিক আচরণকে (Undesirable behaviour) বদ অভ্যাস (Vice) বলা হয়। বদ অভ্যাস জনিত সমস্যা খামারে পালিত মোরগ-মুরগির জন্য অনেক সময় প্রচুর আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ সমস্যা খামারে কোনভাবে খামারে এক বার ছড়ালে তা মোকাবেলা করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পরে। পুরো খামারে ছড়ানো র পূর্বেই প্রাথমিক অবস্থায় এ জাতীয় সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকা দরকার। মোরগ-মুরগির বদ অভ্যাস জনিত সম্যা সমূহের মধ্যে ঠোকরাঠুকরি (Cannibalism) ,ডিম ভক্ষন(Eggs eating) ,ডিম লুকিয়ে রাখা (Eggs hiding) ও বিকৃত রুচির ক্ষুধা (Pica) অন্যতম।

ক) ঠোকরাঠুকরি (Cannibalism) :–

খামারে পালিত মোরগ-মুরগির বদ অভ্যাস জনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা। এতে খামারে পালিত মোরগ-মুরগির মধ্যে অনাকাংখিত ও অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। এ জাতীয় সমস্যা কোন কোন সময় সুস্পস্ট কারণ ছাড়াই আকস্মিক ভাবে খামারে প্রকাশ পেতে পারে। মোরগ-মুরগির ঠোকরাঠুকরির সমস্যা সীমিত আকার থেকে বিস্তৃত আকারে অতি দ্রুত গতিতে সমস্ত খামারে যে কোন বয়সের মোরগ-মুরগিতে যে কোন সময় দেখা যেতে পারে।

ঠোকরাঠুকরির কারণ (Causes of cannibalism) :–

১। সীমিত স্থানে প্রয়োজনের তুলনায় অধিকসংখ্যক মোরগ-মুরগি গাদাগাদি (Over crowding) অকস্থায় পালন করা।

২। বংশগত কারণ—ভারী জাতের মোরগ-মুরগি অপেক্ষা হালকা জাতের মোরগ-মুরগিতে এ জাতীয় সমস্যা অতি তীব্রতর হতে পারে।

৩। প্রয়োজনের তুলনায় খামারে অপর্যাপ্ত সংখ্যক খাদ্য ও পানরি পাত্র সরবরাহ করলে এ সমস্যা হতে পারে।

৪। দূর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ খামার ব্যবস্থাপনা বিশেস করে অতি তীব্র কংিবা অনিয়ন্ত্রীত আলোকদান কর্মসূচি ,অপর্যাপ্ত বায়ু প্রবাহ, অত্যাধিক ব্রুডিং তাপমাত্রা, খামারে অতি তীব্র সূর্যালোক প্রবেশ ইত্যাদি।

৫। যৌনাংগের বহিঃরাংশে রক্ত ক্ষরণ (Haemorrhage in the external genitalia)  — প্রাথমিক অবস্থায় মুরগি বড় আকারের ডিম পাড়লে যৌনাঙ্গের প্রাচীর ফেটে গিয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটে কিংবা কষ্টদায়কভাবে ডিম পাড়ার সময় যৌনাঙ্গের লাল রঙ্গের রঞ্জিত টিস্যু অন্য মুরগিকে সহজেই আকৃষ্ট করে । যৌনাঙ্গের ক্ষরণকৃত রক্ত কিংবা লাল রঙ্গের রঞ্জিত টিস্যুকে ঠোক্কর দেওয়ার পাশাপাশি রক্ত ও টিস্যু ভক্ষণে অভ্যস্ত হয়ে পরে। এমতবস্থায় তা খামারের অন্যান্য মুরগিতেও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পরে।

৬। খাদ্যে প্রোটিন ও খনিজ জাতীয় উপাদনে অভাব বিশেষ করে অরজিনিন,ড্লি মিথিওনিন এবং খাদ্য লবণের ঘাটতি এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তোলে।

৭। বহিঃপরজীবী দ্বারা আক্রান্ত চামড়ায় ক্ষত সৃষ্টির কারণে রক্ত ক্ষরণ ঘটলে এ জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

৮। কোন কারণে খামারর এক মুরগির সাথে অন্য মুরগির যুদ্ধ বেঁধে গেলে কোন মুরগির শরীরের কোন অংশে ক্ষত সৃষ্টির কারণে ঠোকরাঠুকরি লাগতে পারে।

৯। দৈনন্দিন মৃত মোরগ-মুরগি সময় মতো খামার থেকে সরিয়ে ফেলতে দেরী হলে এ জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে।

লক্ষণ সমূহ :–

১। পায়ু পথ ঠোকরানো (Vent picking),

২। পালক তুলে ফেলা(Feather picking),

৩। পায়ের আঙ্গুল ঠোকরানো (Toe picking),

৪। মাথা ঠোকরানো (Head picking),

৫। ডানা ও লেজের গোড়ায় ঠোকরানো (Wings & tail picking) ।

প্রতিরোধ (Prevention) :–

সাধারণভাবে বলা হয় যে, ‘ Prevention is better than cure’ তাই মোরগ-মুরগির ঠোকরাঠুকরি সমস্যা মোকাবেলায় সবচেয়ে সহজ ও গ্রহণযোগ্য দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি হলো উপযুক্ত সময়ে খামারে পারিত মোরগ-মুরগির ঠোট কর্তন (Debeaking) করা। সুতরাং ম্যানুয়াল এ বর্ণিত নিয়মানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে মোরগ-মুরগির ঠোট কর্তন বাঞ্চনীয়।

এছাড়াও উল্লেখিত পদ্ধতি গ্রহণ করার পরেও খামারে পালিত মোরগ-মুরগির মধ্যে যদি ঠোকরাঠুকরি সমস্যা দেখা দেয় তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিম্ন লিখিত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করতে হবে ।

১। খামারে পালিত কোন মোরগ-মুরগি ঠোকরাঠুকরিতে জড়িত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অন্যত্র সরিয়ে ফেলা। অর্থাৎ যে মুরগি ঠোকরায় এবং যে ঠোক্কর খেয়েছে তাদেরকেই দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।

২। কোন কারণে মুরগির শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে এমন মুরগি খামারে থাকলে সেটিকে দ্রুত সরিয়ে ফেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মুরগির ক্ষতস্থান মারগোসা তেল(Margosa oil) / হার্ব ওয়েল (Herb oil) প্রয়োগ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। পার্শ্ববর্তি দেশ ভারত ও শ্রীলংকায় এ পদ্ধতি ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

৩। ত্রুটিপূর্ণভাবে ঠোট কর্তন করা থাকলে তা পূণরায় তাৎক্ষনিকভাবে ঠোট কর্তনের মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে।

৪। খামারে মোরগ-মুরগি গাদাগাদি অবস্থায় থাকলে তা দ্রুত সংশোধন করতে হবে।

৫। খামারে মুরগির আনুপাতিক হারে খাদ্য ও পানির পাত্রের ব্যবস্থা করতে হবে এবং খামারে খাদ্য ও পানির পাত্রের জন্য আলাদাভাবে জায়গা বরাদ্দ দিতে হবে।

৬। মুরগিকে বয়স অনুযায়ী সুষম খাদ্য ও ফ্রেশ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ দিতে হবে। পানির পাত্রে সর্বদা পানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে হবে।

৭। শান্তিপূর্ণভাবে আরামদায়ক পরিবেশে ডিমপাড়া মুরগির ডিমপাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা দক্ষতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। ডিমপাড়ার সময় ঠোকরাঠুকরি শুরু হলে ডিম পাড়ার জন্য নির্মিত বাসায় (Nest) লাল রঙ্গের বাল্ব জ্বালিয়ে দিতে হবে।

৮। প্রয়োজনে খাদ্যের সাথে কাঁচা মাংসের টুকরা ব্যবহার করতে হবে। কাঁচা মাংসের অভাবে ফিস মিল ব্যবহার করা যেতে পারে।

৯। পোলট্রি খাদ্যে প্রয়োজনে মিথিওনিনের পরমিাণ বাড়াতে হবে।

১০। ত্রুটিপূর্ণ আলো ও বায়ু প্রবাহ থাকলে তা দক্ষতার সাথে সংশোধন করতে হবে।

১১। সময় অনুযায়ী পাওয়া যায় এমন শাকের আটিঁ নির্দিষ্ট উচ্চতায় ঝুলিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয় যায়। এছাড়াও তরমুজের ফালি, বাঁধা কপির পাতা খামারে ঝুলিয়ে দিলে এ জাতীয় বদ অভ্যাস কমানো যেতে পারে।

১২। প্রয়োজনে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

খ) ডিম ভক্ষণ (Eggs eating) :–

কোন কোন সময় খামারে পালিত মুরগির মধ্যে নিজেই নিজের ডিম কিংবা একে অন্যের ডিম ভক্ষণ করতে দেখা যায়। এমতঃবস্থায় ,এ অস্বাভাবিক অবস্থা কোন মুরগির মধ্যে দেখা দিলে অন্য মুরগিতেও তা ছড়িয়ে পরে। তাই এ ধরনের বদ অভ্যাস দেখা দিলে দিনে কয়েকবার ডিম সংগ্রহের ব্যবস্থা রেতে হবে।

ডিম ভক্ষণের কারণ (Causes of egg eating): –

১। কোন কারণে মুরগির ডিম ফেটে গেলে কিংবা দূর্ঘটনা জনিত কারণে ডিম ভেঙ্গে গেলে।

২। পাতলা খোঁসাযুক্ত ডিম বা খোঁসা বিহীন ডিম ।

৩। দেরিতে ডিম সংগ্রহ ,ত্রুটিপূর্ণ ডিমপাড়ার বাসা বা স্থান, অসামঞ্জস্য খাঁচার গঠন,ডিমপাড়ার স্থানে নরম বিছানার অভাব ইত্যাদি ।

প্রতিরোধ (Prevention) :–

১। এজাতীয় বদ অভ্যাসে আক্রান্ত মুরগি পৃথক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

২। ডিমের খোঁসা শক্ত করার জন্য খাদ্যে পর্যাপ্ত মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন –ডি সরবরাহ করতে হবে।

৩। ডিম ভক্ষণকারী মুরগিকে বিশেষভাবে নির্মিত আলাদা খাঁচায় রাখার ব্যবস্থ্ করতে হবে।

৪। মুরগির ঠোট কর্তন করতে হবে।

৫। এজাতীয় বদ অভ্যাসে আক্রান্ত মুরগিকে ডিমপাড়ার সময় প্রয়োজনে অন্ধকারে রেখে ডিম পাড়পনো বন্ধ করাতে হবে।

৬। ডিম সংগ্রহের মধ্যবর্তী সময় সংক্ষিপ্ত করতে হবে।

গ) ডিম লুকিয়ে রাখা (Eggs hiding) : 

বন্য মুরগির ডিম লুকিয়ে রাখা মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও গৃহ পালিত মুরগির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। কিন্তু কোন কোন সময়ে এ কু-অভ্যাস গৃহপালিত মুরগি বিশেষ করে লিটার পদ্ধতিতে পালনকৃত মুরগির মধ্যেও দেখা দিতে পারে। তবে এজাতীয় সমস্যা স্বাধীনভাবে ঘোরা ফেরা করে এমন মুরগির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তারা সাধারনত মাঠে খড়-কুটা দ্বারা কংিবা ঝোঁপের মধ্যে ডিম লুকিয়ে রাখে।

প্রতিরোধ (Prevention) : —

১। ডিমপাড়া কালিন সময়ে মুরগির স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা বন্ধ করতে হবে।

২। তাদের জন্য আরামদায়ক ডিম পাড়ার স্থান নির্মাণ করে দিতে হবে।

ঘ) বিকৃত রুচির ক্ষুধা (Pica) : —

ভক্ষণযোগ্য নহে এমন অস্বাভাবিক কিছু বস্তু বিশেস করে পালক, লিটার,কাঠের টকরো,ধাতব পদার্থ, প্লাসটিক , সুতা ইত্যাদি গ্রহণ করাকে বিকৃত রুচির ক্ষুধা বলে। খামার ব্যবস্থাপনা অতি নিম্ন মানের হলে এমন খামারে এজাতীয় বদ অভ্যাস দেখা দেয়। তবে আধুনিক মানের পোলট্রি খামারে এজাতীয় বদ অভ্যাসের সুযোগ নেই ।

বিকৃত রুচির ক্ষুধার কারণ (Causes of pica) : —

১। সুষম খাদ্যের অভাব,

২। দেরীতে খাদ্য সরবরাহ,

৩। কৃমরি সংক্রমণ,

৪। খাদ্যে ফসফরাসের অভাব,

৫। খামারে ঘন ঘন নতুন লিটার স্থাপন ইত্যাদি এ সব কারণে এজাতীয় সম,স্যা দেখা দিতে পারে।

প্রতিরোধ ( Prevention ) : —

১। উন্নতমানের খামার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সুষম খাদ্য সরবরাহ করলে এজাতীয় সমস্যা প্রতিরোধ করা যাবে।

২। উপযুক্ত কারণ সনাক্তকরণ স্বাপেক্ষে যথা সময়ে যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।